• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:২২ অপরাহ্ন

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ

/ ৪০ বার পঠিত
আপডেট: সোমবার, ৪ মার্চ, ২০২৪

অনলাইন ডেস্ক:
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পূর্তিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যাত্রা সহযোগিতা এবং কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে এক নতুন আখ্যানের জন্ম দিয়েছে। এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জটিল ভূ-রাজনীতির মানচিত্রে নিজের অবস্থান খোদাই করেছে। বিগত পাঁচ দশকে জাতি তার উন্নয়নকে জোরদার করতে এবং বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য অংশীদারিত্বের সুবিধা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

স্বাধীনতার ভিত্তি

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যাত্রা শুরু হয়।ভারতের সমর্থনে বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি স্থাপন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তরুণ বাংলাদেশ দ্রুত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা বিশ্ব আসরে তার বৈধতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ তার উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলোর স্বীকৃতি নবজাতক রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। একইসঙ্গে, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (NAM) মিত্রদের সমর্থন আদায় করে বাংলাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এক কূটনৈতিক বিজয়গাঁথা রচনা করেছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার দিনগুলো

১৯৮১ থেকে ২০০০ এর মধ্যবর্তী সময়টি বিশ্বব্যাপী কূটনীতির জন্য এক জটিল সময় ছিল। এই সময়কালে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ধারাবাহিক সামরিক অভ্যুত্থান, গণতান্ত্রিক পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেশটির কূটনৈতিক দক্ষতার পরীক্ষা নিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে তার অঙ্গীকারে অটল থেকেছিল।

এই যুগে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ান আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC)-এর মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আরও জোরদার করেছে। সার্কের মধ্যে সহযোগিতামূলক উদ্যোগ বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচন, বাণিজ্য উদারীকরণ এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বসহ আঞ্চলিক সমস্যা মোকাবেলার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে।

অধিকন্তু, বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং বিশ্ব নিরাপত্তায় তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাপী সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েন করে বাংলাদেশ তার সীমানার বাইরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে।

অর্থনৈতিক কূটনীতি এবং বৈশ্বিক সংহতি

নতুন সহস্রাব্দে প্রবেশ করে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মুখ্য ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে অর্থনৈতিক কূটনীতির একটি যাত্রা শুরু করেছে। জাতি তার অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করেছে, বর্ধিত বাজারে প্রবেশাধিকার এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতার উপায় খুঁজেছে।

এই সময়ের একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত ছিল ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) বাংলাদেশের যোগদান, যা বিশ্ব বাণিজ্য উদারীকরণের প্রতি তার অঙ্গীকারের ইঙ্গিত দেয়। অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তিগুলিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ উদীয়মান বাজারগুলোর সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং তার ক্রমবর্ধমান শিল্পগুলোকে জ্বালানি দেওয়ার জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করেছে।

একইসঙ্গে, বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৈদেশিক সাহায্য এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার সুবিধা গ্রহণ করে বৈশ্বিক উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আরও জোরদার করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক উদ্যোগ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে জোরদার করেছে।

আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে উদয়

সমসাময়িক যুগে বাংলাদেশ আঞ্চলিক শক্তির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও তার বাইরেও প্রভাব বিস্তার করেছে। দেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো একটি কৌশলগত ভারসাম্যমূলক আইন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ঐতিহ্যগত মিত্র এবং উদীয়মান শক্তি উভয়ের সাথে অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করে।

আঞ্চলিক বিষয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান তাৎপর্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনন্য। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানে দেশটির মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা মানবিক কূটনীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি তার অঙ্গীকারকে জোরদার করেছে।

বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্য সংযোগ জোরদার করতে বাংলাদেশ তার ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে পুঁজি করে সামনে এগিয়েছে। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) এর মতো সহযোগিতামূলক উদ্যোগগুলো আঞ্চলিক একীভূতকরণকে সহজতর করেছে, যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশীয় সংযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ

উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বহুজাতিক সন্ত্রাস থেকে শুরু করে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা পর্যন্ত জাতিকে সামনের দিনগুলোতে নানাবিধ হুমকি এবং সুযোগের এক জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।

শেখ হাসিনার কূটনৈতিক বিজয়

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক দশক ধরে দেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার নেতৃত্বে রয়েছেন। তার নেতৃত্বের শৈলী, বাস্তববাদিতা, দূরদর্শিতা এবং গতিশীলতার তার গভীর রাজনৈতিক উপলব্ধির পরিচায়ক। অর্থনৈতিক কূটনীতি শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শেখ হাসিনা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে, বাণিজ্য অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে বৈচিত্র্যময় করতে কূটনৈতিক মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। ‌‘লুক ইস্ট’ নীতির মতো উদ্যোগগুলো এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছে, যখন বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পৃক্ততা উন্নয়ন সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার সুবিধা দিয়েছে৷

জলবায়ু কূটনীতি

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আবাদযোগ্য জমির ক্ষতির মতো হুমকির সম্মুখীন। জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) এর মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দুর্বল দেশগুলোর স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে জলবায়ু সংক্রান্ত পদক্ষেপের পক্ষে শেখ হাসিনা সোচ্চার হয়েছেন। জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব শুধু জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোর দুর্দশার বিষয়ে সচেতনতাই বাড়ায়নি বরং উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু অর্থায়ন ও অভিযোজন সহায়তার প্রতিশ্রুতিও অর্জন করেছে।

আঞ্চলিক রাজনীতি

শেখ হাসিনা শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব স্বীকার করে বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্ততার নীতি অনুসরণ করেছেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখেছে। একইভাবে, চীন, ভুটান এবং মিয়ানমারের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক একীভূতকরণে অবদান রেখেছে।

বহুপাক্ষিক কূটনীতি

ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে বহুপাক্ষিক কূটনীতি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রচার এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে অবদান রাখতে জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন। নিরাপত্তা পরিষদসহ জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলিতে বাংলাদেশের নির্বাচিত হওয়া শেখ হাসিনার কূটনৈতিক বুদ্ধি এবং বৈশ্বিক বিষয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতিকে প্রতিফলিত করে।

মানবিক কূটনীতি

শেখ হাসিনার মানবিক কূটনীতি বিশ্বব্যাপী সঙ্কটের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়ার জন্য বাংলাদেশকে প্রশংসিত করেছে। মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবিক নীতি সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনার অঙ্গীকারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মানবিক সহায়তা প্রদান এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে কথা বলার মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য আশার বাতিঘর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

শেখ হাসিনার কূটনীতি বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী সম্পৃক্ততার জন্য প্রধান চালিকাশক্তি। অর্থনৈতিক কূটনীতি, জলবায়ু রাজনীতি, আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা, বহুপাক্ষিক সহযোগিতা এবং মানবিক সহায়তার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিশ্ব আসরে সম্মানের আসনে উপবিষ্ট করেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কূটনৈতিক অঙ্গনে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


আরো পড়ুন