ফাঁকা মাঠে অথবা রাস্তার ধারে দেখা যায়, তরুণ বয়সি ছেলেদের জটলা। পাশ দিয়ে যেতে কানে আসে, মার! মার! ধর! ধর! গুলি কর! গুলি কর! গ্রেনেড মার! তাড়াতাড়ি গুলি কর! মাইরা ফালা! মোবাইল ফোনের গেমসের এসব কথা এখন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগঞ্জ পেরিয়ে বাজার, ফাঁকা জায়গা, রাস্তা ও যেকোনো অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সম্প্রতিকালে করোনা ভাইরাসের কারণে একটানা বহুদিন বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার ফলে, শিশু থেকে যুবকরা পড়ার টেবিল থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি ও বিভিন্ন বিধি নিষেধ, নিরাপদ দূরত্ব আর লকডাউনের কারণে তারা মাঠে খেলাধুলাও করতে পারিনি। এমন ঘরমুখী বন্দিজীবন এর আগে তারা কখনোই দেখেনি। বলা যায়, প্রাত্যাহিক রুটিন জীবন থেকে সকল শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। আর সে কারণেই তারা মোবাইলে ভিডিও গেমসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীরা।
উপজেলার বিভিন্ন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণ এ প্রতিবেদককে বলেন, বিগত সময়ে গেমস সম্পর্কে কিছু জানতাম না। এখন নিয়মিত ফ্রি ফায়ার গেমস খেলার নেশা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে নেট সমস্যায় এ গেমস খেলতে না পারলে মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলার ইচ্ছা হয়। ফ্রি-ফায়ার গেমস যে একবার খেলবে, সে আর তা ছাড়তে পারবে না।
খেলায় আসক্ত একাধিক ছাত্র জানায়, ফ্রি-ফায়ার গেম খেলতে ডায়মন্ড কিনতে হয়। ১০০ ডায়মন্ডের দাম ৮০ টাকা। ১০৬০ ডায়মন্ডের দাম ৭৯০ টাকা। মেম্বারশিপ সপ্তাহে ১৭০ টাকা, মাসিক ৫১০ টাকা। এ ছাড়া প্রতিটা ইভেন্টে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ না করলে কিছুই হয় না। তারা আরো বলেন, গেমটিতে প্রথমে কোনো খরচ ছিল না। কিন্তু পুরোপুরি মনোযোগী হলে এমন কিছু জিনিস আছে, যা না কিনলেই নয়। যেমন, অলকের দাম ৪০০ টাকা, একজন খেলোয়াড়ের জার্সি ৩০০ টাকা, নতুন ইভেন্ট এলেই ২০০০ এর নিচে যাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ ড্রেস কিনতে লাগে ১২০০ টাকা। আর রেগুলার ইভেন্টের কথা তো বলাই বাহুল্য।
আরো জানা যায়, ইন্টারনেট ব্যবহার করে এসব খেলতে হয়। আর ইন্টারনেট ডাটার যে দাম কি করে পেরে উঠবে অভিভাবকরা? তাছাড়া এই খেলার খেলোয়াড়রা যেভাবে কথা বলে তা দেখলে মনে হবে পাগল! সারাদিন বকাবকি করে। সারাদিনের এই বকাবকি তাদের ঘুমের ঘোরেও প্রভাব ফেলে। দিনে ব্যবহৃত বিভিন্ন রকমের শব্দ ঘুমের ঘোরেও বলতে শোনা যায়।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, মূলত এই খেলার সুযোগ এসেছে সরকার অনলাইন ক্লাস শুরু পদ্ধতি থেকে। ক্লাসগুলো যদি অনলাইনে না দিয়ে কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে সর্বশেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতো, তবে আমাদের মনে হয় ভালোই হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক বলেন, অনেক ছেলে-মেয়েরা অনলাইন ক্লাসের নাম করে নতুন মোবাইল কিনেছে। কিন্তু ক্লাসে তাদের বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। এভাবে চলতে দেওয়াটা ভালো ফল বয়ে আনবে না। দেশ, সমাজ ও জাতি অতিদ্রুত ধ্বংসের কবলে পড়তে যাচ্ছে। ব্লু-হোয়েলের মতো ভয়ঙ্কর রূপ নেওয়ার আগেই এই খেলা বন্ধ করা দরকার। সরকারের উচিত এই ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।
তাড়াইল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে এ ফ্রি-ফায়ার নামক গেমে সবচেয়ে বেশি আসক্ত হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। অনেকেই এই খেলার পেছনে অর্থ ব্যয় করছেন। অভিভাবকসহ সমাজের সবাই মিলে এ বিষয়ে তদারকি না করলে ভবিষ্যতে ফ্রি ফায়ার নামক গেম মাদকের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তাই এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।