• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৫:৫৮ অপরাহ্ন

কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের রাজী হারলেন যে কারণে

/ ১০৭ বার পঠিত
আপডেট: শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৪

মেহেদী হাসান রিয়াদ, নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের ২ বারের সাবেক সংসদ সদস্য। সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন হেভিওয়েট প্রার্থী। এর আগে তিনি ২০০৮ সালে দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ চেয়াম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে যোগদান করলেও ২০১৪ সালে কুমিল্লা-৪ আসনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে শুরু হয় বিতর্ক। দলীয় কোন্দলে নেতাকর্মীদের কাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি।


গত ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচিতও হয়েছেন তিনি। এছাড়াও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেবিদ্বার উপজেলার সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে কেন্দ্রে মনোনয়নের জন্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এর নাম প্রস্তাব পাঠানো হলে তিনি দলীয় মনোনয়ন পায়। তবে তার বিরোধী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ এর কাছে প্রায় ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি।
এদিকে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ২০২২ সালে উপজেলা পরিষদ উপ-নির্বাচনে দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তিনি গত ২০ নভেম্বর ২০২৩ উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে সরকার দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদন জমা দেয়। তবে সরকার দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।


এই আসনে আওয়ামী লীগের রাজী মোহাম্মদ ফখরুল ৮১ হাজার ২৫৭ ভোট পেয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বদ্বী আবুল কালাম আজাদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ে ঈগল প্রতীকে তিনি ৯৬ হাজার ৮০৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। বর্তমান সময়ে তরুণ রাজনীতিবিদরা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তারা কখনো যুব সমাজের আইকন, কখনো উঠতি বয়সের যুবকদের অভিভাবক। তারাই আবার যুবসমাজের সর্বনাশের কারিগর। তেমনি এক আইকন-অভিভাবক রাজনীতিবিদ ছিলেন কুমিল্লা- ৪ (দেবিদ্বার) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। তরুণ এ নেতা তার সংসদীয় আসনে প্রবীন নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে গড়ে তুলেছেন যুবরাজনীতির কারখানা। তার হাত ধরে একের পর এক যুবক, কিশোর পা বাড়িয়েছেন রাজনীতিতে। আর সেটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তার জন্য।

এছাড়াও বিএনপি-জামায়াত সক্ষ্যতা, আওয়ামীলীগ প্রার্থীর বিরোধিতা, বিদ্যুৎ সংযোগে অনিয়ম, সরকারি অর্থ লুটপাট, নিয়োগ বানিজ্য, ট্যান্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সংসদ ভবনের ভেতরে আ’লীগ নেতাকে মারধর, সংসদীয় এলাকাকে মাদকের স্বর্গরাজ্য তৈরি সহ এহেন কোনো অপকর্ম নেই যার সাথে যুক্ত নন এ সাংসদ।
তথ্য মতে, হাইব্রিড এমপি রাজী ফখরুলের অপকর্মে কোণঠাসা হয়ে ওঠেছিলো দেবিদ্বারের তৃণমূল আওয়ামীলীগ। সরকারপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু পরিচয়ে প্রচার করা এ সাংসদরে প্রভাবে প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিলো উপেক্ষিত ও নির্যাতিত। তার পিতা প্রায়ত এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী তৎকালীন জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে এরশাদ সরকারের অর্থ-উপমন্ত্রী নির্বাচিত হলেও পরে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। সব শেষ তার পুত্র রাজী ফখরুল এমপি হওয়ার কারণে তিনি হয়েছিলেন আ’লীগ সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্যও। তিনিই তার সু-পুত্রের অপকর্মের প্রধান হাতিয়ার।


প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রতিটি গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করার মূখ্য ভূমিকা পালন করে এলজিইউডি’র বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ। কিন্তু অত্যন্ত হতাশাজনক হলেও সত্য যে এলজিইউডি’র যে কোনো ট্যান্ডারে এমপি রাজী ও তার বাবা ফখরুল ইসলাম মুন্সীকে কাজের আগেই অন্তত ২০% টাকা চাঁদা দিতে হতো।
জানা গেছে, স্বতন্ত্র এমপি থাকা কালে রাজী ফখরুল দেবিদ্বার উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার নামে প্রায় ৫০ হাজার সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এছাড়াও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘নাইটগার্ড’ নিয়োগ, পুলিশের কনস্টেবল পদে এমপি’র কোটায় নিয়োগ দিতে জনপ্রতি কমপক্ষে ১০ লক্ষ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন এমপি ও তার বাবা। টাকা নিয়েও চাকুরি না দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি গঠন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ ও এমপিওভুক্ত করার নামে শিক্ষকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। স্বজনপ্রীতির নামে মেধাহীন, বিএনপি/জামাত-শিবিরের লোকদের চাকরি দেওয়ার নাম করেও হাতিয়ে নিয়েছেন আরও কয়েক কোটি টাকা। নিয়মিত লুটপাটে দেবিদ্বারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই যেন ছিলো তার টাকা তৈরির কারখানা।

সরকার দলীয় সংসদ সদস্য হওয়ার পরও রাজী ফখরুল উপজেলায় টিআর, কাবিখা, এডিবি, এলজিএসপিসহ বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কাজের বরাদ্দকৃত টাকা ও মালামাল লুটপাট করেছেন। যার ফলে দেবিদ্বারের রাস্তাঘাটগুলো বেহাল দশায় পরিনত হয়েছে। যার সর্বোচ্চ প্রমাণ তার নিজ বাড়ি বনকোট থেকে উপজেলা সদরে আসার সড়কটি। একবার উপজেলা চেয়ারম্যান, দুইবার এমপি হওয়া স্বত্ত্বেও এ সড়কের সংস্কার করতে পারেননি তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে বিলাশবহুল বাড়ি সহ বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়তে গিয়ে জনগণের টাকা লুটপাট করে আওয়ামীলীগের প্রতি জনমনে ক্ষোভ তৈরির কারণ হয়েছেন সাবেক এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল।


এদিকে তরুনদের হাতে রাজনীতি তুলে দিয়ে প্রবীন রাজনীতিবিদদের হটিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া প্রবীনদের সাথে খারাপ আচরনের কারণে সরকার প্রধানের কাছেও রয়েছে অভিযোগ। জানা যায়, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন এর জানাযার নামাজে গিয়ে দেবিদ্বারের ত্যাগী আ’লীগ নেতা, কুমিল্লা উত্তর জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক রোশন আলীকে গুলি করার হুমকি দিয়ে ছিলেন এ সাংসদ। এছাড়া গত উপজেলা পরিষদ উপ-নির্বাচনে নৌকা ডুবাতে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষেও কাজ করছেন মরিয়া হয়ে।


জানা যায়, ঐ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। তার বিপরীতে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন এমপি রাজী ফখরুলের আপন চাচা এএফএম তারেক মুন্সীর জন্য। তার নিজ কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছিল ১৬ ভোট। একই কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে তার চাচা পেয়েছিলেন ৯৮১ ভোট। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এএফএম তারেক মুন্সী বিএনপি থেকে দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন প্রত্যাশী।


সূত্রে জানা যায়, এর আগে এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের চাচা এবং এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সীর ছোট ভাই ‘হংকং বিএনপি’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালে গত ২০১৩ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় তাকে রাতারাতি আওয়ামী যুবলীগের নেতা বানিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ফলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম সফিকুল আলম (ভিপি কামাল) নির্বাচনে জয়যুক্ত হতে পারে নাই। ভিপি কামাল উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে পারলে আসনটি তিনি আওয়ামী লীগকে উপহার দিতে পারতেন। এদিকে দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচনের মতোই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের কেন্দ্রে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের ০৮ নম্বর কেন্দ্র বনকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৌকার প্রার্থী মো. হুমায়ুন কবির পেয়েছিলেন ১৮২ আর বিদ্রোহী প্রার্থী মো. আবদুল হাকিম খান পেয়েছেন ৬৫৮ ভোট। নির্বাচনের এক দিন আগে আওয়ামী লীগের ১০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন স্থানীয় এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল নৌকার বিরোধিতা করছেন। নিজের পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন। জানা গেছে, ওই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেবিদ্বার উপজেলার ১৫ টি ইউনিয়নের মধ্যে শুধু মাত্র চার ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের জয় হয়েছে। বাকি ১১ টি কেন্দ্রে এমপির যোগসাজসেই ভরাডুবি হয়েছে নৌকা প্রতীকের।


জানা গেছে, এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী দেবিদ্বার এখন মাদক সম্রাজ্য। এই সম্রজ্যের সম্রাট স্বয়ং দেবিদ্বারের সাবেক এমপি রাজী ফখরুল। তিনি মাদক সিন্ডিকেট থেকে প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা গ্রহণ করেন। এমন কি খেটে খাওয়া সিএনজি-অটোরিক্সা থেকে জিবি ও টোকেন মানির নামে প্রতি মাসে অন্তত ১০ লাখ টাকা এবং সাব-রেজিস্টার অফিস থেকে প্রতিমাসে ১০-১২ লক্ষণ টাকা চাঁদা আদায় করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে বর্তমান এমপি আবুল কালাম আজাদ নির্বাচিত হওয়ার পর পরই জিবি ও টোকেন মানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে প্রবীন রাজনীতিবিদরা বলছেন, এমপি রাজী ফখরুলের এহেন কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে দেবিদ্বারের তৃণমুল আওয়ামী লীগ। আর এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের যত উন্নয়ন ম্লান হতে বসেছে। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেছে দেবিদ্বার উপজেলার ১৫ ইউনিয়ন ও পৌরসভার তৃণমুল আওয়ামী লীগের ঐক্য ফোরাম। এর ফলেই এবার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়েছে রাজী ফখরুলকে। এছাড়াও দেবিদ্বারের আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ফিরে পেতে কয়েক দফায় প্রধানমন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর লিখিত অভিযোগও করেছেন তারা।


বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক এই এমপির দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রচার করা হলেও তার চাপের মুখে সব কিছুই বন্ধ করে দিতে হয়েছে বহুবার। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার পরও দুদক এর চোখ কেন তাকে এড়িয়ে চলছে? নাকি সরকার এবং জনগণের চোখের অন্তরালে নীল খামের চালান চলে হরহামেশাই? এমন প্রশ্ন তৃণমূল আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের।


আরো পড়ুন