• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ন

জাল সনদে হয়েছেন কর্মকর্তা, পদোন্নতিও চান মশিউর

/ ১৩৩ বার পঠিত
আপডেট: রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের ডেমোনস্ট্রেটর (তবলা) মো. মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মশিউর রহমান ভর্তি হন। অল্প দিনেই সখ্যতা গড়ে ওঠে বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে। ফলস্বরূপ ২০১০ সালে এইচএসসি পাসের সনদ ব্যবহার করে তবলা সহায়ক (বাদক) পদে চাকরি পান।

মশিউর বিভাগের শিক্ষকের সুপারিশেই চাকরি পেয়েছিলেন। যার সত্যতা মিলেছে সে সময়ের বিভাগীয় প্রধান ড. রশিদুন নবীর কথায়।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভেতরে হওয়ায় তখন কেউ আসতে চাইত না, তখন তবলা বাদকের জন্যে সার্কুলার দেওয়া হয়। সে সময় বিভাগের সহকর্মী শাকিল হাসমী আমায় বলেন, মশিউরকে চাকরিটা দেওয়া যায় কি না। তিনি আমায় বলেন, ছেলেটা অস্বচ্ছল, ভালো তবলা বাজায়, ওকে চাকরিটা দিলে উপকার হবে। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে, সকলে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে মশিউরকে চাকরিটা দেওয়া হয়। একটা সময় পর ছাত্রত্বও বাতিল করে নেয় সে।

ছাত্রত্ব বাতিল করে চাকরি করায় এইচএসসি পাস ছাড়া আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না মশিউরের। তবে নিষিদ্ধ হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইবাইস ইউনিভার্সিটি’ থেকে আইনে স্নাতক সম্পন্ন করার সনদ জমা দিয়েছিলেন এই কর্মকর্তা। জমা দেওয়া সনদের কোথাও লেখা নেই অর্জিত জিপিএ এবং রেফারেন্স। এমনকি ব্যক্তিগত নথিতে জমা নেই একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট। সনদে স্নাতক পাসের কথা লেখা থাকলেও নেই সময়কাল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সনদটি জালিয়াতি করে বানানো হয়েছে। সনদে পাসের সাল দেখানো হয়েছে ২০১৪। এই সময়ে বিভাগে কর্মরত ছিল মশিউর। চাকরিতে থেকে কোনোভাবেই স্নাতক করা সম্ভব নয়। তাছাড়া কোনো অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। সবশেষ চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সিনিয়র ডেমোনস্ট্রেটর পদে পদোন্নতির জন্যে বিভাগে আবেদন করলে প্ল্যানিং কমিটি তা আটকে দেয়।

প্ল্যানিং কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মশিউরের সনদটি দেখে তাদের সন্দেহ লাগলে তার কাছে ট্রান্সক্রিপ্ট চাওয়া হয়। সেটি এখনও দিতে পারেনি। ফলে প্ল্যানিং কমিটি তার আবেদন গ্রহণ করেনি। সভায় তার ব্যক্তিগত নথির সন্ধান চাইলে তা হারিয়ে গেছে বলে বিভাগকে জানায় মশিউর।

এ বিষয়ে বিভাগটির প্রধান অধ্যাপক ড. জাহিদুল কবীর বলেন, আপগ্রেডেশনের জন্যে আবেদন করেছিল মশিউর। জমা দেওয়া সনদ ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ায় প্লানিং কমিটি গ্রহণ করেনি। তবে এর সমস্যা আছে কি না, তা দেখবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবিধি অনুযায়ী, দশম গ্রেডের কর্মকর্তা হতে হলে তাকে স্নাতক পাস হতে হবে। তবে মশিউর রহমান সেই নিয়মকে পরোয়া না করেই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকে হয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ ডেমোনস্ট্রেটর মশিউর রহমান।

তিনি বলেন, আমি এইচএসসি পাস করেই তবলা বাদক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেছি। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছি ডেমোনস্ট্রেটর। আর এখানে আমার মূল সনদ রয়েছে। এটি জালিয়াতি করা নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছে আমার পাস করার অনেক পরে।

সনদে জিপিএ এর তথ্য উল্লেখ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মশিউর বলেন, এটা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাইল।

সনদের বিষয়ে জানতে ইবাইস ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে দেওয়া ঠিকানায় যোগাযোগ করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সঙ্গীত বিভাগের একজন শিক্ষক জানান, মশিউর রহমান যদি স্নাতক সম্পন্ন করে থাকেন, তবে তাকে অবশ্যই ক্লাস-পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তাহলে সেটি কখন কীভাবে করেছে? এই প্রশ্ন থেকেই সনদের ধরন কী, তার উত্তর পাওয়া যায়। বিভাগ তার পড়াশোনার বিষয়ে অবগত নয়। আমাদের প্ল্যানিং কমিটিও বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে তার আপগ্রেডেশন সংশ্লিষ্ট সুপারিশ আটকে রেখেছে।

বিভাগের অধ্যাপক ড. রশিদুন নবী বলেন, তার পড়াশোনা করার বিষয়ে আমি অবগত নই। বিভাগেই লোকবল কম ছিল, সে এর মধ্যে কোন সময় এসব করেছে সেটা আমাদের জানা নেই।

মশিউর রহমান শুরুতে এটিকে স্বাভাবিক স্নাতক পাস বলেছে। তবে সুর বদলে তিনি এখন বলছেন, এটি উইকেন্ড প্রোগ্রামের আন্ডারে করেছেন। স্নাতক পর্যায়ে এই উইকেন্ড চালুর সত্যতা মেলেনি। এমনকি মশিউর রহমানের উপস্থাপন করা সাময়িক সনদের কোথাও এই প্রোগ্রামের কথা উল্লেখ নেই।

আরও নিশ্চিত হতে মশিউর রহমানের কাছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট আইডি চাইলে তিনি পরে দেখাবেন বলেও প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। এমনকি মুঠোফোনে কল করে পুনরায় চাইলেও তা তিনি এড়িয়ে যান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এভাবে আপগ্রেডেশন দিয়ে কর্মকর্তা বানানো অনুচিত। এতে এই ক্ষেত্রে অযোগ্যদের সম্মানিত করে সম্মানিতদের অসম্মানিত করা হয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেখিয়ে সেটি করা হয়েছিল সেটি নিয়ে আমরা আগেও বিতর্ক শুনেছি। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও সে আজ কর্মকর্তার পরিচয় দিচ্ছে, যা লজ্জার। এটি কেবল লজ্জার নয় সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ।

সনদ জালিয়াতির বিষয় নিয়ে রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। এলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে বিভাগই মূলত সুপারিশ করে। এর আগে কীভাবে পেল, সেটিও যাচাই করে দেখতে হবে। এ বিষয়ে বিভাগ আমাদের জানালে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সঙ্গীত বিভাগের ডেমোনস্ট্রেটর মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগের পাশাপাশি রয়েছে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, ড্রাইভার, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মেস মালিকদের থেকে ওষুধ ব্যবসায় পার্টনার করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়াসহ সুদে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেড় কোটি টাকার অধিক অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।


আরো পড়ুন