• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৪:৫৯ অপরাহ্ন

বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সাংবাদিকের দিনলীপি

/ ৩৬৪ বার পঠিত
আপডেট: সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২০
বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সাংবাদিকের দিনলীপি
বক্ষব্যাধি হাসপাতালে সাংবাদিকের দিনলীপি

অ আ আবীর আকাশ:- ঢাকা মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের দিনলিপি লিখতে বসে চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে পড়েছি। আমি কি সত্যটুকুন বলব? সত্য বলার পরে প্রতিক্রিয়া কি সৃষ্টি হবে? জনগণের পক্ষে যাবে আমার বলা কথাগুলো। কিন্তু সে জনগণ কি আমার পক্ষে আওয়াজ তুলবে? যদি জনগণ আমার পাশে না থাকে, তাহলে কিভাবে- কার জন্য লিখবো? লিখেই বা লাভ কি অথবা সত্য বলার নামে শত্রু বাড়িয়ে কি লাভ?
সরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র তথা হাসপাতাল এ দেশের জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নির্মাণ করা হয়। সরকার থেকে প্রতিনিয়ত চাপ থাকে সুন্দরভাবে, আন্তরিকভাবে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দিতে। তবুও আমরা কি সে আন্তরিক সেবা পাচ্ছি?
* ২৭.০৯.২০২০,রোববার,দুপুর আড়াটা।
আমাকে নিয়ে সিএনজিটা সদরঘাট থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বকুলতলায় গিয়ে থামল। দ্রুত টিকিট কাউন্টারের সামনে গেলাম। টিকেট চাইতেই বলা হল-‘টিকেট আজকের জন্য দেয়া শেষ, আগামীকাল সকালে আসেন।’
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হতে আমার ফুসফুসে পানি ধরা পড়ে। সে থেকেই বলা যায় আমি অসুস্থ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও কার্যত ফল না পেয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হাবিব উদ্দিন আহমদ এর তত্ত্বাবধানে একমাস চিকিৎসা নিয়েও ফল হয়নি।পরে তিনিই আমাকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
টিকেট না পেয়ে হতাশ হলেও চিকিৎসা পাওয়ার আশায় মনকে বুঝিয়ে রাখলাম। পরে একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতায় মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে ফিরে হোটেলের রুম নিলাম। জানতে পারলাম এই হোটেলে সব কোভিড ১৯ বা করোনা পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষমান বিদেশফেরত যাত্রীতে ঠাসা। এ কথাগুলো শুনে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আরো চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে করোনা বা জীবাণুনাশক স্প্রে সেপনিল খুঁজতে লাগলাম। প্রায় ৩০ দোকান খোঁজা শেষে একটা ফার্মেসিতে পেলাম। দ্রুত সেপনিল নিয়ে হোটেলে নেয়া রুমের সর্বত্রই স্প্রে করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
* ২৮.০৯.২০২০,সোমবার ভোর ৫টা।
ফজরের আযানের সময় উঠে ধর্মীয় কার্যসম্পাদন শেষে দ্রুত ছুটলাম বক্ষব্যাধি তথা এনআইডিসিএস হাসপাতালে। এত ভোরে আসলাম যে, আমি সিরিয়ালের ২ নং টিকেট প্রত্যাশী হলাম।
সাড়ে আটটায় শুরু হল ১০ টাকার টিকিট বিতরণ। ক্রিকেট নিয়ে থোরাসিক সার্জারি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক দেলোয়ার হোসেনের কক্ষের সামনে দাঁড়াতেই চিকিৎসক দালালের মাধ্যমে নেয়া আমার লাল টিকেটে লিখে দিলেন কোভিড টেস্ট করে নিয়ে আসতে। কোন কথা বলার সুযোগ দিলেন না, আমার সাথে থাকা পরীক্ষার কাগজপত্র কিছুই দেখলেন না। দালাল বলল- ‘ডাক্তার করোনা পরীক্ষা ছাড়া কোন কিছুই দেখবেন না।’
কোথায় কি করে জানিনা। নতুন আমি, চিকিৎসা নিতে এসেছি। অগত্যা সেধে সেধে উপকার করা মানুষের একজনের সহযোগিতা চাইলাম। সে বহু লেকচার শুনিয়ে পাশেই থাকা শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নিয়ে গেলেন এবং একজন আনসারের সহযোগিতা চাইলেন। আনসার শুধু আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন- ‘ওই রুমে যান ওখানে ফরম আছে, টিকিট আছে নেন।’ এই জন্য আনসারকে দিতে হল 200 টাকা।
আনসারের দেখানো রুমে গিয়ে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে জানতে পারলাম-আজ আর করোনা ভাইরাস এর নমুনা নেয়া হবে না, আগামীকাল ভোরে আসতে হবে। তারপর নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে হবে অগত্যা উপকার করনেওয়ালার সহযোগিতায় দিন ৩শ টাকা করে ছোট্ট একটা খুপরি ঘর ভাড়া নিলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায়।
* ২৯.০৯.২০২০,মঙ্গলবার,সকাল ৭টা।
শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ২ নং গেটের সামনে অপেক্ষমান করোনা ভাইরাস তথা কোভিড নাইনটিন রিপোর্টের জন্য। একজন আনসার বলল-‘সাড়ে আটটা ছাড়া কাউকে পাবেন না, অপেক্ষা করুন।’ ঠিক সময়ের মধ্যে তারা এলেন। টিকেট কাউন্টারে ফরম নিয়ে পূরণ করে আলাদা ভবনে গিয়ে সিরিয়াল দিলাম তিন নম্বরে। আমার আগে যিনি দিলেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, পদোন্নতির জন্য ভাইভা পরীক্ষা দিবেন তার জন্য করোনা পরীক্ষা করতে হবে। করোনা ভয় একটু প্রশমিত হলেও এক নাম্বারের যিনি নমুনা দিলেন তার কি অবস্থা, আল্লাহ জানেন! সঙ্গে স্প্রে সেপনিল নিয়ে গেছি, উঠতে-বসতে-কাগজপত্রে স্প্রে করছি। আমার ডাক পড়লো। চেয়ারে বসতে হবে, সে চেয়ারের আদৌপ্রান্ত স্প্রে করে দিয়ে বসেছি। যিনি নমুনা সংগ্রহ করতে এলেন তাঁর হাতের যন্ত্রপাতি ও তার গায়ে স্প্রে করে দিলাম। নমুনা সংগ্রহ শেষে একজন বলল- ‘ভাইজান সম্মানী করবেন না’! একশ টাকা দিতেই বললো -‘আমরা দুজন।’ কয়দিনে রিপোর্ট পাবো জানতে চাইলে ও জানালো তিনদিন পরে পাবেন। আর কি করবো হোটেলে খাচ্ছি, অপেক্ষা করছি।
* ৩০.০৯.২০২০,বুধবার
রাতের খাবার নেয়ার জন্য হোটেলে আসলাম, তখন রাত সাড়ে ন’টা। হোটেলের বিল দিতে কাউন্টারের সামনে এলে ম্যানেজার বললেন-‘ভাই আপনাকে তো আগে কখনো দেখিনি, গত কয়দিন ধরে দেখছি হোটেলে আসতেছেন, কোথায় থাকেন নাকি?’ বললাম ভাই আমি নিজেই অসুস্থ, ফুসফুসে পানি জমেছে। অপারেশন করতে হতে পারে। হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছিলাম না, ডাক্তার কোভিড নাইনটিন পরীক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া কোনো কাগজপত্র দেখেননি। ম্যানেজারের পাশেই বসেছিলেন একজন দাঁড়িওয়ালা মাঝবয়েসী লোক। তিনি বললেন-‘আপনি কি এখন জরুরি বিভাগে যেতে পারবেন? ওখানে গিয়ে খোঁজ নিবেন যে কোনো সিট খালি আছে কি না?’ আমি বললাম-পারব। তাহলে বাসা নিয়েছি, তাদের খাবার দিয়ে এক্ষুনি আসছি। বাসায় এসে আমার স্ত্রীকে বিষয়টা বলতেই ও যেতে রাজি হলো। আমরা দুজনে হোটেলের কাউন্টারের সামনে এলে সেই ভদ্রলোক বললেন -‘আমি ফোন দিচ্ছি, উনি ফোন করে জানতে পারলেন মেডিসিন বিভাগে সিট খালি আছে এবং চিকিৎসক ও জরুরি বিভাগে আমার নাম বলে ভর্তি নিতে বললেন। সত্যিই লোকটি উদার, ভালো মানুষ। আমরা দ্রুত জরুরি বিভাগে গেলাম। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক বুকের এক্সরে করতে দিলেন। বুকের এক্সরে করিয়ে নিয়ে পুনরায় চিকিৎসককে দেখালে তিনি নিশ্চিত হয়ে ভর্তি দিলেন। ভর্তির কাগজটা একজন পুরুষ লোকের কাছে দিলেন। তিনি ২০/২১ নং ওয়ার্ডের ২২ নং খালি সিট দেখিয়ে পুরনো চাদর সরিয়ে একটা ধোয়া চাদর দিয়ে বললেন-‘বকশিশ দেন।’
* ০১.১০.২০২০,বৃহস্পতিবার।
পুরো কক্ষ জুড়ে সব টিবি রোগী। সকাল সাড়ে নয়টায় চিকিৎসক এলেন, তিনি আমার সকল কথা শুনলেন। টিবি, সিবিসি, হেমাটোলজিসহ একগাদা পরীক্ষা দিয়ে গেলেন। এবার এসব পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আজকে আরো হাফ অফিস, সবার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। আমরাও হন্য হয়ে ছুটি পরীক্ষার নমুনা দিতে পারলে অন্তত শনিবার রিপোর্ট পাবো সে লক্ষে। ইনশাআল্লাহ সকল পরীক্ষার নমুনা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সেরে বিকেলের দিকে একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য সুযোগ পেলাম।
* ০২.১০.২০২০,শুক্রবার।
শুয়ে বসা থাকা, অসহ্য গরম আর টিবি রোগীদের লাগাতার কাশি মনে ভয় উৎকন্ঠা ইত্যাদি নিয়ে চিপিয়ে থাকা। জুমার নামাজ বক্ষব্যাধি হাসপাতাল জামে মসজিদে আদায় করার মাধ্যমে দিন পার হলো।
* ০৩.১০.২০২০, শনিবার।
পরীক্ষাসমূহের রিপোর্ট সংগ্রহ করতে করতে শেষ হলো দিন। এখানে ওখানে একে-ওকে, যেতে যেতে, ধরতে ধরতে আর ‘মালপানি’ দিতে দিতেই শনিবার দিন শেষ। এর ফাঁকে কোন ট্রিটমেন্ট বা চিকিৎসা চলেনি আমার। তবে চিকিৎসা চলবে বা পাবো এই আশায় আছি।
* ০৪.১০.২০২০,রোববার।
পরীক্ষার সমুদয় রিপোর্ট নিয়ে বসে আছি। চিকিৎসক এলেন, দেখলেন। দেখে তিনি থোরাসিক সার্জারি বিভাগে রেফার করলেন। চিকিৎসা লিখলেন না।
* ০৫.১০.২০২০, সোমবার,সকাল ৮টা।
নাস্তা খেয়ে কাগজপত্র রিপোর্ট নিয়ে থোরাসিক সার্জারি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে ১/২নং ওয়ার্ডে যাই। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ডাক্তার মানবেন্দ্রের সহযোগী জানিয়ে দিলেন-‘বুধবার সকাল আটটার দিকে আসবেন, আজ আর কোনো রোগী বা কাগজপত্র দেখবেন না।’ নিরুপায় হয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেডিসিন বিভাগের বিছানায় চলে এলাম। তবে একটা সুবিধা আছে এ হাসপাতালে, তাহলো হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে অন্য আরেক চিকিৎসকের কাছে রেফার করলে ভর্তি না  হওয়া, সিট না পাওয়া পর্যন্ত পূর্বের ভর্তি ও সিট বলবৎ থাকে।
পরে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন আমাদের তো কোভিড নাইনটিন পরীক্ষা হয়েছে, এবার আবাসিক চিকিৎসক দেলোয়ার হোসেনকে দেখান।
তবে ভর্তি আছেন এটা বলবেন না। এরকম উৎসাহ পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে কোভিড নাইনটিন রিপোর্টসহ সকল এক্স-রে নিয়ে দেখা করতেই কাগজপত্র দেখে ভর্তি দিলেন। এবার সিট পাওয়ার যুদ্ধ। সিট খালি না থাকলে ভর্তি নিবে না সার্জারি বিভাগ।
* ০৬.১০.২০২০,মঙ্গলবার,ভোর ৫টা।
লাল টিকিটে আবার তারিখ বসিয়ে ভর্তি নেয়া আবাসিক চিকিৎসক দেলোয়ার হোসেনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র দেখিয়ে কাউন্টারে কে কার আগে টিকেট জমা দিতে পারে এমন লড়াই চলে। শোকর আলহামদুলিল্লাহ সিট লড়াইয়ে টিকলেও ‘অর্থনৈতিক সাপোর্ট’ দিতে হয়। যদিও হাসপাতাল পরিচালকের অমীয় বাণী বড় বড় অক্ষরে লিখে সাঁটানো আছে’আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত,রশিদ ছাড়া টাকা লেনদেন করবেন না।’এখন কথা হচ্ছে রশিদ নিজেইতো টাকা চায় তাহলে আর কি করবো!
অবশেষে সার্জারি বিভাগের অনেকগুলো ওয়ার্ডের ৩/৪ নং ওয়ার্ডের ৪নং সিট পেলাম। যে শুধু দেখিয়ে দিলো ওয়ার্ড কোনদিকে তাকেই দিতে হলো জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে। যে ছেলেটা বেডকভার বদলে দিল তাকে দিতে হলো ১০০ টাকা।
* ০৭.১০.২০২০,বুধবার।
সকাল থেকে উৎকণ্ঠা আজ সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক মানে বড় চিকিৎসক আসবেন। তিনি আসবেন বলে সর্বত্রই সাবধানতা বজায় রাখতে চেষ্টা করছে নার্স বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। যত জটিল রোগী হোক না, কারো সাথে ভিজিটর রাখছেন না। ডাক্তার দলবল নিয়ে রোগী দেখা শুরু করলেন। রোগীরা আত্মীয়স্বজন একা একা কাগজপত্র নিয়ে যার যার সিটে বসে আছেন। কারো সাথে কারো ভাব বিনিময় হচ্ছে না। ডাক্তার সাহেব নাকি মেজাজি, ছাড়পত্র দিয়ে সোজা বের করে দিবেন। যথাক্রমে আমার শারীরিক বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান রিপোর্ট দেখে পুনরায় সিটি স্ক্যান করতে দিলেন।
* ০৮.১০.২০২০,বৃহস্পতিবার।
সকালে নার্স রুম থেকে টোকেন এল সিটি স্ক্যান করতে হবে। বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সামনে গজিয়ে ওঠা লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিকের দালালরা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমাকে ধরলো তাদের সাথে যেতে। লাইফ কেয়ার এর গাড়িতে নিবে, আবার এনে দিয়ে যাবে। খরচ সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বললাম কমাও, ৭শ টাকা মানে ৬ হাজার ৮শ টাকার নিচে কমাতে পারল না। আমিও লাইফ কেয়ারে করলাম না সিটিস্ক্যান। পরে অন্য ব্যবস্থা করে সিটি স্ক্যান করে নিলাম হাফের চেয়েও কম দামে।
* ০৯.১০.২০২০,শুক্রবার।
মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতে এপর্যন্ত আমি ভালো আছি, এজন্য তার আনুগত্য প্রকাশ করে শুক্রবার দিনটি পার করে দিলাম। এদিকে হাসপাতালে ধোয়া-মোছার অভিযান।
* ১০.১০.২০২০,শনিবার।
শুয়ে বসে গল্প গুজব করে ও ঘুমিয়ে এদিনটাও পার করে দিলাম। আমার এ পর্যন্ত এ হাসপাতালে চিকিৎসার নামে কেবল মাত্র ৪ পিস ওমেপ্রাজল, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ক্যালসিয়াম ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা পাইনি।তবে চিকিৎসা পাবো এই আশা করেই চললাম। গত তিন-চার দিন ধরে সকালে নার্সরা এসে রোগীদের বিছানায় ঝোলানো সাইনবোর্ডে জ্বর আছে/ নাই লিখে যান।
* ১১.১০.২০২০,রোববার।
আজ আবার সেই বড় পন্ডিত চিকিৎসক আসবেন। ততদিনে তার নাম জেনে গেছি অধ্যাপক ডাক্তার মফিজুর রহমান মিয়া। মুখভরা দাড়ি, মাথায় টুপি, ব্যবহার অত খারাপ না দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তবুও কেন নার্সরা রোগীদের ভয় দেখিয়ে যায়। তারা বকা শোনার ভয়ে রোগী ও রোগীর আত্মীয় স্বজনদের সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে রাখেন।
আজ যথাসময়ে ও যথানিয়মে রোগী দেখা শুরু করলেন। আমার বিছানায় এসে সিটিস্ক্যানের ফিল্মগুলো দেখে বললেন আমি এ রোগীর অপারেশন এর পক্ষে না। যদি অপারেশন করা হয় তাহলে রোগীর ব্যথা বেড়ে যাবে, আরও খারাপ হবে। এই বলেই উনি আরেক রোগীর কাছে চলে গেলেন।
আমার কোনো চিকিৎসা নেই এ পর্যন্ত। হোটেল থেকে খাবার এনে খাচ্ছি, এখানে মশার কামড় খেয়ে ঘুমাচ্ছি, স্ত্রী ও এক কন্যা শিশু কষ্ট পাচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্যরা চিকিৎসা পেলেও আমি যেন ছাগলের তিন নম্বর বেবির মতো। দুই দুধের বাটে দুই বেবী আর আমি দৌড়াই লাফাই আর নেচে গেয়ে যাই অবস্থা।
* ১২.১০.২০২০,সোমবার।
চিকিৎসাহীন ভাবে চলল আমার দিনগুলো। গোসলখানা ও টয়লেটে এক দিন পর পর সন্ধ্যার দিকে অথবা ফজরের সময় থেকে পানি থাকেনা। অজু গোসল করা ও প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে এ সময়। এজন্য রোগীরা প্রথম প্রথম ক্ষেপলেও পরে তা মানিয়ে নিয়েছে। সকালের নাস্তায় প্রায় সময় আইটেম মিস হয়। দুপুরে খাবারের সংকট থাকে। নানা সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় থাকতে হচ্ছে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ৩/৪ ওয়ার্ডের ৪নং শয্যায়।
* ১৩.১০.২০২০,মঙ্গলবার।
সকালে ‘ছাড়পত্র’ এলো আমার নাকি ছুটি! অপারেশন লাগবে না। ছাড়পত্রে চিকিৎসা হিসেবে ঔষধ লিখে দিলো -ডকোপা (২ মাস),ট্রাইলক (২মাস),অমিপ্রাাজল (২মাস)ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। এই চিকিৎসা নিতে আমার প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আরও ৫০ হাজার টাকার হয়রানি, মানসিক চাপ, কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ছাড়পত্রে উল্লেখ করে দিয়েছে পরবর্তীতে কোনো ব্যথা বা জরুরী প্রয়োজনে আউটডোরে সেই আবাসিক সার্জনকে দেখাতে!
**
সিটি স্ক্যান মেশিন,ইকো কার্ডিওগ্রাম মেশিন ছাড়া হাসপাতাল দিলো বুঝি সরকার। বড়ো পরীক্ষাগুলো বাহিরে করতে হয় রোগীদের।
অসংগতিঃ
* রান্নাঘরে হিন্দু মেয়ে লতা মুসলমানের জন্য রাঁধেন। * খাবারের মান ভালো না। * সবজী ডালের মতো ঝোল হয়ে যায়। * বয়লার মুরগী ক্যান্সার সৃষ্টি করলেও প্রতিদিনই বয়লার মুরগী পরিবেশন করে। * আয়াদের প্রতিকাজে টাকা দিতে হয়।* টাকা না দিলে রোগীদের মান-সম্মান তুলে বকাঝকা করা হয়। * রোগীরা ছাড়পত্র পেলে আয়াদের ঈদ, জনপ্রতি ১শ টাকা করে দিতে হয়। * কুকুরের উৎপাত,রাতে পায়খানা করে পরিবেশ খুবই দূষণ করে।
লেখকঃ কবি প্রাবন্ধিক কলামিস্ট ও সাংবাদিক।
সম্পাদকঃ আবীর আকাশ জার্নাল


আরো পড়ুন