তারেকুর রহমান:এই ওভারে ডাক দে হাকিম; এগারো তে পাঁচশত!সলিম ডাক দে, দশ এ এক হাজার!এভাবে প্রতি ওভার বলের পেছনে জুয়ার আড্ডা চলে বিপিএল,আইপিএল কিংবা বিশ^কাপের মতো বড় বড় ক্রিকেট আসরে। এগারো তে পাঁচশত মানে চলতি ওভারে সর্বনি¤œ ১১ রান করবে ব্যাটিং পক্ষ তার বিনিময়ে ৫০০ টাকা। ১১ এর বেশি হতে পারবে, কম হলে ওই টাকা যাবে প্রেডিকশন সঠিক হওয়া ব্যক্তির পকেটে। এভাবে ১০ রানে হাজার, ৭ রানে ৫’শ/৩’শ/২’শ ডাক দিয়ে প্রতিনিয়ত জমছে জুয়ার আসর আর কুলষিত হচ্ছে সমাজ। স্কুল কলেজে যাওয়া ছাত্ররাও কাঁধের ব্যাগ চায়ের দোকানের টেবিলে রেখে এ বাজিতে মত্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে সমাজের উঠতি বয়সের তরুণসহ বয়স্করাও আর এর পরিণাম ভোগ করতে হয় পরিবারের আপজন কিংবা স্ত্রী সন্তান-সন্ততিদের। জুয়ার নেশায় ব্যাকুল হয়ে ঘরের বউয়ের গলার হার, আংকটি, চুড়ি বিক্রি করে জুয়ার আসরে বসছে স্বামী, মায়ের কাছ থেকে আলমারীর চাবি কেড়ে নিয়ে হাতের পাঁচ শেষ করে দিচ্ছে কিশোররা।আপনি কক্সবাজার শহরের অলিতে-গলিতে একটু ঘুরলে অবশ্যই দেখতে পাবেন যেদিন খেলা থাকবে সেদিন প্রতিটি রং চায়ের দোকানে কেতলির্পূণ চা, অন্যান্যদিনের চেয়ে ওই দিন চায়ের কাপ বেশি ধুয়ে রাখছে দোকানদার, প্রতিদিনের তুলানয় ওই দিন দোকানে চেয়ার টেবিলের সংখ্যা বেশি।
এই প্রসারতার কারণ কি নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝার বাকি রইল না আপনার? ওই যে হাকিম-সলিমদের আগমনে সবকিছু ঠিক ঠাক রাখছে দোকানদার কুতুব।ছেলেকে সাথে নিয়ে মা যাচ্ছিল ফার্মেসীতে ঔষুধ কিনতে পাশের রং চায়ের দোকানে খেলা চলছে। ছেলের কানে আওয়াজ আসলো এই ওভারে ৯ তে ৫০০ টাকা। অন্যজনের ভিন্ন ডাক!
ওই ভয়ঙ্কর মজার ডাক গুলো ছেলেকে কেড়ে নিল মায়ের কাছ থেকে। মাকে একা যেতে হলো ফার্মেসীতে তাও আবার ঔষুধ কিনতে নেয়া টাকা থেকে অর্ধেক টাকা নিয়ে। বাকি অর্ধেক টাকা নিয়ে ছেলে বসলো জুয়ার আড্ডায়। দরদী মাকে হেনতেন বুঝিয়ে ঔষুধের টাকা থেকে অর্ধেক টাকা নিয়ে বসে পড়লো আট এ চারশত, দশ এ পাঁচশত ডাক দেয়া হাকিম ভাইদের আসরে। এই রকম মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে স্কুলের ড্রেস পড়ে ব্যাগ নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষার্থীর মতো ঘর থেকে বেরিয়ে, স্ত্রীর সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথে, বোনকে কোচিং এ পৌঁছে দেয়ার পথে, পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাওয়ার পথে শত শত যুবক আটকে যায় জুয়ার আসরে।
একদিন খেলা চলাকালীন সময়ে পাহাড়তলীর একটি দোকানে লক্ষ্য করলাম একজনের হাতে টাকার বান্ডিল, তা দেখে পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে গেলে একটু দোকনের কাছে গিয়ে লোকগুলোর গা ঘেঁষে মনোযোগ সহকারে খেলা দেখার ভান করছিলাম আর তাদের ডাক শুনছিলাম, অবস্থাটি দেখে খুব খারাপ লাগলো বটে, আরো অনুতপ্ত হলাম একে অপরকে মায়ের নামে অশ্লীল বাক্যে গালি দিতে শুনে, একে অপরকে চায়ের কাপ ছুড়ে মারার উপক্রমের দৃশ্যটিও উপলব্ধি করতে ভুল করিনি । যাই হোক, এহেন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে সাহস করে তাদের একজন থেকে মৃদু হাসি মুখে রেখে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম ‘ভাই এখানে এই দুষ্টুমীগুলো কি নিয়মিত হয়? তিনি আমায় বলেন, কিসের দুষ্টুমী? আমি বললাম এই যে টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে প্রতি ওভারে বাজি ধরার দুষ্টুমী? তিনি প্রতি উত্তরে বলেন, ‘পাগল হয়ছেন ঘরে জানেনি? এতো টাকা নিয়ে কেউ দুষ্টুমী করে? দেখছেন না কি অবস্থা।
অথচ ভাইটি বুঝলো না আমি কেন ‘দুষ্টুমী’ শব্দটি ব্যবহার করলাম। আমার কি বাঁচার আশা নেই? তখনো আমার শরীরে কম্পনের মাত্রা বয়ে চলছে।
আবার জিজ্ঞেস করলাম ‘ভাইয়া এখানে পুলিশ আসে না? তিনি কিন্তু এবার বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, ‘ওই যে ওনার হাতে যে টাকা গুলো দেখছেন সেগুলো পুলিশের জন্য। পুলিশ আসলে এই টাকা গুলো একজন গিয়ে দিয়ে আসে। তারপর তারা ডিস্টার্ব করেনা, চলে যায়’। তার উত্তরটি শুনে তখন খুব খারাপ লাগলো। ছেলেটি কি আসলে পুলিশের নামে মিথ্যে বলছে নাকি এই জুয়াঁ খেলা বন্ধে পুলিশের অবহেলা! কোনটা? আর কথা না বাড়িয়ে স্থানটি ত্যাগ করলাম।এ পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে আসন্ন বিশ^কাপ ক্রিকেট ২০১৯ এর ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে। ‘ফাইনালে দুই ল্যান্ড এতে বাজি ধরে লোকসানে আমাদের মাদারল্যান্ড’। সদ্য ফাইনালে যাওয়া নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের খেলা নিয়ে এরই মাঝে জুয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে জুয়াড়িরা। আপনি একটু খোঁজ নিয়ে দেখলেই প্রমাণ পাবেন, ৫০ ওভারের খেলাকে কেন্দ্র করে মাতৃভূমির আনাছে কানাছে গড়ে উঠছে লাখ লাখ টাকার বাজি। এই বাজিতে হেরে অনেকে ভারসাম্যহীন রূপে প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে মারামারি,ছুরিকাঘাতসহ নানা জঘন্যতম কাজের জন্ম দেয় যা ছাত্রসমাজ, তরুণ-বয়স্ক ও একটি পরিবার-সংসার ধ্বংসের কারণ।
এমতাবস্থায় আপনি কি মনে করছেন না এতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারী ও ব্যবস্থা প্রয়োজন?বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের টেকপাড়া, কালুর দোকান, পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, মোহাজের পাড়া ও সমিতিপাড়া এলাকায় এই অপকর্মগুলো বেশি লক্ষণীয়। যা আমি নিজেই অনুসন্ধান করে, খেলা চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে দিনে দুয়েকবার সরেজমিনে গিয়ে এই লিখনিটা আপনাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি।
বাজি নামের এই কুসংস্কারপূর্ণ জঘন্য কাজটি অবশ্যই দূর করা দরকার বলে আমি মনে করছি, আপনি মনে করছেন কি?লেখক:
তারেকুর রহমান
স্টাফ রিপোর্টার: দৈনিক হিমছড়ি
tarekcox01@gmail.com