• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

চাকরিচ্যুত সেই শরীফের আপিল শুনানি ৯ ফেব্রুয়ারি

/ ১০১ বার পঠিত
আপডেট: মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৩

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক পদ থেকে চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিন চৌধুরীর রিটের শুনানি আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ শুনানির জন্য এ দিন ধার্য করেন।

একই সঙ্গে আপিল আবেদনকারী শরীফ উদ্দিন চৌধুরীর রিটের পক্ষে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে লিখিত যুক্তি-তর্ক জমা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন আপিল আদালত।

শরীফ উদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে আদালতে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. সালাহ উদ্দিন দোলন। দুদকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।

এর আগে ২০২২ সালের জুনে শরীফ উদ্দিনের রিটের শুনানি (স্ট্যান্ডওভার) মুলতুবি রাখার বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। গত বছরের ১৬ জুন আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করেন শরীফ উদ্দিনের আইনজীবী মো. সালাউদ্দিন দোলন।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি চাকরিচ্যুত করা হয় শরীফ উদ্দিনকে। তখন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা আদেশে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪(২)-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মো. শরীফ উদ্দিন, উপসহকারী পরিচালক, দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যক্রম, পটুয়াখালীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো।’ প্রজ্ঞাপনে অপসারণের কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।

এই বিধি নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান রয়েছে বলে জানায় চাকরিচ্যুতির বিষয়ে আন্দোলনকারীরা। তাদের দাবি, দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪ বিধির কার্যকারিতার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দুদকে ২০১৪ সালে যোগদান করা একজন কর্মকর্তাকে কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তিনি কোনোরূপ অপরাধ করেছেন কি না, সে বিষয়টি তাকে অবহিত না করে ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়, যা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থী।’

বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সাংবাদিকদের দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, উনি (শরীফ উদ্দিন) কর্মচারী চাকরি বিধিমালা-২০০৮-এর বাইরে অনেক কাজ করেছেন। যেটা আমি পাবলিকলি বলতে চাই না। ফলে দুদক মনে করে ভাবমূর্তি রক্ষার্থে সবার স্বার্থে, এ জন্য ৫৪-এর (২) ধারা এখানে প্রযোজ্য হয়েছে। তার মানে এই না যে, এ ধারা আমরা সবজায়গায় প্রয়োগ করব। এটি একেবারে শেষ, চরম পর্যায়ে চলে গেলে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটির একটি অংশ। তার বিরুদ্ধে অনেক কমপ্লেইন রয়েছে। বিভাগীয় মামলা চালু আছে। অনেকগুলো কমপ্লেইন আসছিল, অনেকগুলো এসেছে।

অবশ্য চাকরিচ্যুতির এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বিরাগভাজন প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের চাপের কারণেই কি শরিফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করা এবং সর্বশেষ চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের বিষয়ে টিআইবি ধোঁয়াশা স্পষ্ট করতে দুদককে আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মঞ্জুর-ই-আলম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে বিশাল অঙ্কের দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও মামলা পরিচালনায় মূল ভূমিকায় জড়িত ছিলেন। এ সময় যেসব সিন্ডিকেট তার বিরাগভাজন হয়, তাদের চাপেই শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার গুঞ্জন ও অভিযোগের বিষয়ে দুদকের স্পষ্ট অবস্থান জনতে চেয়েছে তারা।

টিআইবি বলছে, দুদকের চাকরিবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মীকে অপসারণের এখতিয়ার দুদকের হাতে থাকতেই পারে, কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেন অপসারণের পথ বেছে নিতে হলো তা দুদকের নিকট থেকে জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে দুদকের অবস্থান পরিষ্কার করার আহ্বান জানিয়ে টিআইবি বলছে, জনমনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলে দুদকের বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরতর সংকটের মুখে পড়বে।

অপসারণের পর থেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন। যে কোনো সময় গুম হয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) এ আশঙ্কার কথা জানান সদ্য চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিন। তিনি একটি অজ্ঞাত জায়গা থেকে কথা বলছিলেন গণমাধ্যমকে।

সদ্য চাকরিচ্যুত শরীফ উদ্দিনের পক্ষ নিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মানববন্ধনে অংশ নেয়া দুদক সচিবকে দাবিদাওয়া সংবলিত স্মারকলিপি দেন তারা।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তিনি কোনোরূপ অপরাধ করেছেন কি না, তা অবহিত না করে ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়, যা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থী। আদালতে বিচারাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিতর্কিত ৫৪(২) ধারা মোতাবেক শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ বাতিলের দাবি জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারীরা।’

‘দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারী হিসেবে আমরা দুদকের মিশন-ভিশন বাস্তবায়নের জন্য দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করি, যার নজির রয়েছে দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার চলমানও রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চাকরি বিধিমালা (কর্মচারী)-২০০৮-এর ৫৪(২) বিধিতে বলা হয়েছে, এ বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারবে।’

এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে) নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থাগ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না।’

‘দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮-এর ৫৪ বিধি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-১৪২৪/২০১১ দায়ের করা হলে ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগ দুদক চাকরি বিধিমালার ৫৪ বিধিকে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আদালত ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের ৫৪ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণাটি বহাল রাখেন। অর্থাৎ ৫৪ বিধি অনুযায়ী দুদকের কোনো কর্মচারীকে সংবিধানের ২৭, ২৯, ২১ ও ৪০ অনুচ্ছেদ বলে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে কাউকে ৯০ দিনের বেতন দিয়ে স্থায়ী রাজস্ব খাতভুক্ত চাকরি থেকে অপসারণের অবকাশ ছিল না। কিন্তু কমিশন আপিল বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের বিপরীতে ৩২/২০১৭ সিভিল রিভিশন করলে একতরফা (রিটকারীর প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে) শুনানি করে ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত করেন এবং বিষয়টি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এর ৫৪ বিধির কার্যকারিতার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দুদকে ২০১৪ সালে যোগদান করা একজন কর্মকর্তাকে কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তিনি কোনোরূপ অপরাধ করেছেন কি না, সে বিষয়টি তাকে অবহিত না করে ১৬ ফেব্রুয়ারি ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়, যা অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থী।’

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘মো. শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি তার চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত থাকাকালীন ৫২টি মামলা করেন। এছাড়া তিনি আদালতে বিচারের জন্য ১৫টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) প্রস্তুত ও দাখিল করেন। শরীফ উদ্দিন কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদ্ঘাটনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শরীফ উদ্দিনের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে সংক্ষুব্ধ পক্ষগুলো বিভিন্ন সময়ে তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। অথচ ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে, যা প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ারই সমার্থক।’

‘এমতাবস্থায় মো. শরীফ উদ্দিনকে অসাংবিধানিক ও অমানবিক অপসারণ আদেশ প্রত্যাহার ও দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) বিধি বাতিল পূর্বক কমিশনের কর্মকর্তাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর সই করা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগে গত বছরের জুনে তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়েছিল।


আরো পড়ুন