রাত পোহালেই উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। ইতোমধ্যে সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সম্মেলন ঘিরে দলটির সর্বোস্তরের নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে।

শনিবার (২৪ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে ১৯৫৫ সালের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দলটির ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সম্মেলনের মাধ্যমে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে কার্যনির্বাহী কমিটি পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছেন শত শত নেতা।

আওয়ামী লীগের ৭৩ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সভাপতি হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ নয়বার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দুইবার এবং এএইচএম কামারুজ্জামান ও আবদুল মালেক উকিল একবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন একবার নির্বাচিত হয়েছেন দলের আহ্বায়ক। এ ছাড়াও মহিউদ্দিন আহমেদ দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।

অন্যদিকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ৯ জন। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিল্লুর রহমান সর্বোচ্চ চারবার করে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদ তিনবার এবং আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও ওবায়দুল কাদের দুইবার করে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং আবদুল জলিল একবার করে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পাকিস্তান আমলে সম্মেলন:

১৯৪৯ সালের ২৩ থেকে ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে প্রায় ৩০০ জন প্রতিনিধি ছিলেন। পরে প্রতিনিধিদের সমর্থনে ৪০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এই সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হন।

১৯৫৩ সালের ৩ থেকে ৫ জুলাই মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনেও সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা ভাসানী। আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর রূপমহল সিনেমা হলে দলের তৃতীয় সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। এই সম্মেলনেও পুনরায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৭ সালে চতুর্থ সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। ১৩ জুন আরমানিটোলার নিউ পিচকার হাউজে এবং পরদিন গুলিস্তান সিমেনা হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রতিনিধি ছিল আটশ জন। এতে প্রতিনিধিদের ভোটে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৪ সালের ৬ মার্চ থেকে ৮ মার্চ দলের পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ছিল প্রায় ১ হাজার। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হন মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ সালের ১৮ থেকে ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য ঐতিহাসিক একটি সম্মেলন। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দলীয় ফোরামে পাশ হয়। এই সম্মেলনে কাউন্সিলর ও ডেলিগেটের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৪৩ জন। এর মাধ্যমে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। আর সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ।

১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে আটক তখন অনুষ্ঠিত হয় দলের সপ্তম জাতীয় সম্মেলন। ১৯ থেকে ২০ অক্টোবর হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রায় ১ হাজার ৪৫৩ জন কাউন্সিলর ও ডেলিগেট এতে অংশ নেন। এই সম্মেলনেও পুনরায় শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৭০ সালের উত্তাল সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের অষ্টম সম্মেলন। ৪ থেকে ৫ জুন হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কাউন্সিলর ছিল ১ হাজার ১৩৮ জন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে ছয় দফা ও ১১ দফা গ্রহণ করে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেয় আওয়ামী লীগ। কাউন্সিলরদের ভোটে এই সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

স্বাধীন বাংলাদেশে সম্মেলন:

১৯৭২ সালের ৭ থেকে ৮ এপ্রিল সার্কিট হাউজ রোডে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম এবং সব মিলিয়ে নবম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য শপথ নিয়ে এ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ সালের ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি সার্কিট হাউজ রোডে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের ১০ম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা দলের পদে থাকতে পারবেন না। ফলে বঙ্গবন্ধু দলীয় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলের সভাপতি হন এএইচএম কামারুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক হন জিল্লুর রহমান।

এরপরই ঘটে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের ভেতরে নিহত হন আওয়ামী লীগের চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুঃসময় এসে হাজির হয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে ১৯৭৭ সালের ৩ থেকে ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে দলের ১১তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কাউন্সিলর ছিলেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন এবং ডেলিগেটও সমসংখ্যক ছিল। এতে দলের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। এর পরের বছর ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১২তম জাতীয় সম্মেলন। ৩ থেকে ৫ মার্চ হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কাউন্সিলর এবং সমসংখ্যক ডেলিগেট নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলনটি। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল মালেক এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুর রাজ্জাক।

১৯৮১ সালের ১৩তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন শেখ হাসিনা। দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য নেতৃত্বে আনা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। ১৯৮১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ছিল ৩ হাজার ৮৮৪ জন। সভায় শেখ হাসিনা সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক দল ত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

১৯৮৭ সালের ১ থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ১৪তম জাতীয় সম্মেলন। এতে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ছিল প্রায় ৪ হাজার। এই সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৯২ সালের ১৯ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ১৫তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়। এতে কাউন্সিলর ছিলেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ ও ডেলিগেটও ছিলেন সমসংখ্যক। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৯৭ সালের ৬ থেকে ৭ মে আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ১৬তম জাতীয় সম্মেলন ছিল আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রায় ২১ বছর পর দলটি ক্ষমতায় আসার পর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কাউন্সিলর ছিলেন ২ হাজার ৫১৬ এবং ডেলিগেটও ছিলেন সমসংখ্যক। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পুনঃনির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও জিল্লুর রহমান।

২০০২ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে তখন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় দলের ১৭তম জাতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল জলিল।

২০০৮ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৮তম জাতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনে শেখ হাসিনা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় দলটির ১৯তম জাতীয় সম্মেলন। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

২০১৬ সালের ২২ থেকে ২৩ অক্টোবর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এরপর সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের।