• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৪ অপরাহ্ন

চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের ছোঁয়া

/ ১০০ বার পঠিত
আপডেট: বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২

১৯৭১, বাংলার দামাল ছেলেরা বর্বর হানাদার পাকবাহিনীর থেকে কেড়ে এনেছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নাম তার বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পতাকায় যেন জড়িয়ে রেখেছে গোটা জাতিকে। মুক্তিবাহিনীর দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। তারই পরিণততে অর্জিত হয় বাংলার বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পর্দায় শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আর্তনাদ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আর তীব্র সংগ্রাম যেন ফুটে উঠেছিল কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায়। এটি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র না হলেও এতে প্রতিফলন ঘটেছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে ফখরুল আলম পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘জয়বাংলা’। তবে ছবিটি প্রথমে পাকিস্তানি সেন্সর বোর্ড আটকে রাখলেও, পরে ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় সিনেমাটি।

এরপর একে একে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ শিরোনামে দুটি প্রামাণ্য ছবি নির্মাণ করেন জহির রায়হান। এ ছাড়া আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন প্রামাণ্য ছবি ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন্স’। ওই সময় এসব প্রামাণ্য ছবিতে পাকিস্তানিদের বর্বরতা, গণহত্যা, অসহায় মানুষের আহাজারি, দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব এবং মুজিবনগর সরকারের নানা পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়।

স্বাধীনতার পরে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম সিনেমা ‘ওরা ১১ জন’। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে। ছবির গল্পে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার অদম্য সাহসিকতা এবং বাংলা ভাষার জন্য রক্তের বিনিময়ে তাদের সেই সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, আনন্দ পরিচালিত ‘বাঘা বাঙালি’ এবং মমতাজ আলী পরিচালিত সিনেমা ‘রক্তাক্ত বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের ছবি হলেও এগুলোতে পাকস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

১৯৭৩ সলে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির নির্মাণ করেন সিনেমা ‘ধীরে বহে মেঘনা’। একই বছর নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’, কবীর আনোয়ারের ‘শ্লোগান’, আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’সহ উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে এই ছবিগুলো। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের নির্মম পরিস্থিতি ফুটে ওঠে ১৯৭৪ সালে নির্মিত নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’ এবং এস আলীর ‘বাংলার ২৪ বছর’ সিনেমায়।

১৯৭৪-১৯৭৫ সালে খুব একটা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ হয়নি। ওই সময়টাতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ একেবারেই কমে যায়। পরে ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় হারুন-অর-রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ এবং ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় আবদুস সামাদের পরিচালনায় সিনেমা ‘সূর্যগ্রহণ’। এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে আনেন নির্মাতা। তবে ১৯৮১ সালে শহীদুল হক পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘কলমীলতা’ মুক্তির পরে মুক্তিযুদ্ধে সিনেমা নির্মাণে ভাটা পড়ে।

তবে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ব্যাপক অধঃপতন। যা পরে নব্বই দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আর এ সময়টাতেই বিকল্পধারা হিসেবে উপস্থাপিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এসব ছবিতে প্রাধান্য পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব চিত্র। মুক্তিপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’, তানভীর মোকম্মেলের ‘হুলিয়া’ ও ‘নদীর নাম মধুমতি’, নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’, মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’, আবু সাইয়ীদের ‘ধূসর যাত্রা’ সিনেমাগুলো ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

এরপর তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন প্রামাণ্য ছবি ‘মুক্তির গান’। দেশজুড়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয় ছবিটি। এছাড়া আরও নির্মিত হয়- দেবাশীষ সরকারের ‘শোভনের একাত্তর’, রফিকুল বারী চৌধুরীর ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’, জাঁ-নেসার ওসমানের ‘দুর্জয়’, হারুনুর রশীদের ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, বাদল রহমানের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’, ছটকু আহমেদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন’, মান্নান হীরার ‘একাত্তরের রঙপেন্সিল’ সিনেমা।

১৯৯৪ সালে লম্বা বিরতির পর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন তার পরিচালিত প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমণি’। ১৯৯৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এবং ২০০৪ সালে ‘মেঘের পর মেঘ’ নির্মাণ করেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। একই বছর হুমায়ুন আহমেদ তৈরি করেন ‘শ্যামলছায়া’ এবং অভিনেতা তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘জয়যাত্রা’। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১০ এ নির্মিত হয়, ৭১-এর গেরিলা, ৭১-এর সংগ্রাম, মেঘমল্লার, অনুক্রোশ, হৃদয়ে-৭১ এবং ৭১-এর মা, জননী। ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধা নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু নির্মাণ করেন ‘গেরিলা’ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে শাহজাহান চৌধুরী নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আমার বন্ধু রাশেদ’।

২০১৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ রচিত উপন্যাস অবলম্বনে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক শাহ আলম কিরণের ‘৭১ এর মা জননী’, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামলছায়া’ সিনেমাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীনির্ভর ছবি ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ নির্মাণ করেন পরিচালক নুরুল আলম আতিক।

আবার লম্বা একটা বিরতির পর, ২০২০ সালে তরুণ নির্মাতা রায়হান রাফি নির্মাণ করেন ‘দামাল’। যা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কিশোরের ‘জয় বাংলা’ উপন্যাস অবলম্বনে প্রয়াত নির্মাতা কাজী হায়াত নির্মাণ করেন সিনেমা ‘জয় বাংলা’। একই বছর নির্মিত হয় অনন্য মামুনের ‘রেডিও’, এস এম শাহীন এবং হাসান জাফরুল বিপুলের ‘মাইক’, খিজির হায়াত খানের ‘ওরা সারজন’, হৃদি হকের ‘১৯৭১ সেই সব দিন’, রোজিনার ‘ফিরে দেখা’, এবং তৌকীর আহমেদের ‘স্ফুলিঙ্গ’।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক মহাকাব্য। যা দামাল ছেলেদের কষ্টে অর্জিত বাংলাভাষার নিবেদিত সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আজও। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো আগামীর প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে বাঙালি জাতির ঐতিহ্য।


আরো পড়ুন