• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:৪৮ পূর্বাহ্ন

১৯৭১ সালে কেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, জড়িত কারা?

/ ৯৬ বার পঠিত
আপডেট: বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২

১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল। এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে রাও ফরমান আলীকে অভিযুক্ত করার কারণ যুদ্ধ শেষে পাওয়া তার ডায়েরিতে বহু বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীর নাম ছিল। এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ওপর উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা না হওয়ার কারণে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য রীতিমতো নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ।

তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস ধরে বুদ্ধিজীবী নিধন চললেও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দুদিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে ধরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ও তার দোসরদের শেষ আঘাত।

এ দেশীয় আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় তালিকা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিথযশা ব্যক্তিদের হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, দখলদার বাহিনীর হাতে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশে ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবী প্রাণ হারান। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ১৪৯ জন ঢাকায় শহীদ হন। তবে ১৪ ডিসেম্বরের কালরাতে একসঙ্গে বহু বুদ্ধিজীবীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, দেশীয় আলবদর বাহিনীর কারা কখন কীভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছে, তা স্পষ্ট নয়।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কীভাবে তারা পরিকল্পনা করেছে, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিল্পীসহ সারাদেশের শহর-গ্রামে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো এ নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হয়নি।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংঘ পুরোপুরি আলবদরে রূপান্তরিত হওয়ার আগে থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চলে। তবে আলবদর বাহিনী গঠিত হওয়ার পর সুনির্দিষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়িত্ব তাদের ওপরে দেওয়া হয়। ঢাকায় মাইক্রোবাসযোগে সবাইকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে আলবদর বাহিনী।

বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী রাও ফরমান আলী বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। ঢাকার তৎকালীন গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) পাওয়া রাও ফরমান আলীর ডায়রিতে নিহত ও নিখোঁজ অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা আছে।

মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ যৌথভাবে পাকিস্তানে গিয়ে ১৯৮৯ সালে রাও ফরমান আলীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। যা ‘সেই সব পাকিস্তানী’ শীর্ষক বইতে প্রকাশিত হয়। তবে ওই সাক্ষাৎকারে রাও ফরমান আলী বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তার জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

রাও ফরমান আলী বলেন, ‘কাউকে হত্যা করতে হলে কি আমি এভাবে তালিকা সংরক্ষণ করব? অনেকে আমার কাছে এসে অনেকের নামে অভিযোগ করত। যেমন তিনি এটা করছেন, ওকে সাহায্য করছেন। আমি তাদের নাম টুকে রাখতাম, এর সঙ্গে ওই হত্যার কোনো সম্পর্ক নেই।’

এ বিষয়ে মুনতাসীর মামুন বলেন, রাও ফরমান আলী যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে কোনো না কোনভাবে জড়িত, সেটা পরবর্তীকালে কিছু কাগজপত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এর সঙ্গে পুরো সামরিক জান্তা জড়িত ছিল।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীরও নীলনকশা ছিল বলেও মনে করেন ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন।

তিনি বলেন, কোনো বাঙালি কর্মকর্তাকে কোনো পদে না রাখার নির্দেশনা ছিল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে তখনকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সবাই জড়িত ছিলেন।

এদিকে, ২০১৩ সালে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ওই ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের উদ্ধৃতি দিয়ে তৎকালীন সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান জানান, ১৯৭১ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানের নির্দেশনায় এবং সম্পৃক্ততায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন আলবদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। মুঈনুদ্দীন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ২৫ মার্চ থেকে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু হয়েছিল। প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল। কারণ পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রথম দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-শিক্ষকরা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সামরিক শাসকদের ক্ষোভ ছিল। পরবর্তীতে তা আরও বেড়েছে।

তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দিলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারলেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এ চিন্তা থেকেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে শুরু করেছিল সামরিক জান্তা।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল ছাত্র ও শিক্ষাঙ্গন।

যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বুঝতে পারে পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে, তখন তারা এ দেশীয় আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা।


আরো পড়ুন