• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৫ অপরাহ্ন

অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটে জিম্মি রোগী

/ ১১৬ বার পঠিত
আপডেট: শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২২

রাত আনুমানিক ১০টা। রাজধানীর বনানী এলাকায় সিএনজি অটোরিকশায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন জহিরুল ইসলাম। আনা হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। প্রয়োজনীয় লাইফ সাপোর্ট না থাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অথবা বড় কোনো বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন দায়িত্বরতরা। নিকটদূরত্বের বেসরকারি হাসপাতাল এভারকেয়ারে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্বজনরা।

মাত্র সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ২ হাজার টাকা দিতে হয় অ্যাম্বুলেন্স চালককে। সিন্ডিকেটের কারণে সুযোগ ছিল না দরকষাকষি বা অন্য অ্যাম্বুলেন্সে রোগী তোলার। পরদিন ফের অ্যাম্বুলেন্সে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিতে খরচ হয় আরও ৩ হাজার টাকা। জহিরুল ইসলাম নামের ওই রোগী আর বাঁচেননি। তবে মৃত্যুর আগে দেখে গেছেন চিকিৎসা খাতের পদে পদে অমানবিক নৈরাজ্য। চিকিৎসা খরচ জোগাড়ে যখন তার স্বজনরা হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন রোগীর শারীরিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটগুলো পকেট কাটার নগ্ন খেলায় মেতেছিল। এদিকে গত বৃহস্পতিবার মাদারীপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার আবদুল্লাহ ফয়েজকে অ্যাম্বুলেন্সে আনা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। এ জন্য তার পরিবারকে গুনতে হয়েছে ১১ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘিরেই গড়ে উঠেছে অ্যাম্বুলেন্সকেন্দ্রিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। রোগী বা রোগীর স্বজনদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন তারা। অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্সের মালিক হাসপাতালের কতিপয় কর্মচারী ও তাদের স্বজনরা। অনেক রাজনীতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীরাও জড়িত এই সিন্ডিকেটে। তাদের কারও অ্যাম্বুলেন্স আছে, কেউ আবার মাসোয়ারা পান। সরেজমিন ও বিভিন্ন মহলে কথা বলে জানা গেছে, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ডজনের মতো শক্তিশালী অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের রয়েছে পৃথক সমিতি ও নেতা। হাসপাতালগুলোর আশপাশেই রয়েছে তাদের অলিখিত অফিস। তারাই অ্যাম্বুলেন্সগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। চাইলেই কেউ কম ভাড়ায় অন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে পারে না। কেউ বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেলে তাতে রোগী উঠতে দেওয়া হয় না। বেশি টাকায় তাদের কাছ থেকেই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে হয়।
শেরেবাংলানগর এলাকার চারটি হাসপাতালের একাধিক অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার ভিতর রোগী বহন করতে তারা ২ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন। ঢাকার হাসপাতাল থেকে আশপাশের জেলায় রোগী নিতে ৫ থেকে ১২ হাজার টাকা নেওয়া হয়। একটু দূরের জেলার ক্ষেত্রে অনেক সময় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের অভাব ও অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনায় কোনো নীতিমালা না থাকার সুযোগে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা। রোগীদের জিম্মি করে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধনের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের কর্মচারীরা বিভিন্ন হাসপাতালের নামে নিবন্ধন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাইক্রোবাস কেটেও বানানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। এগুলোতে নেই রোগী বহনে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম। কাগজপত্র ছাড়াই লক্কড়ঝক্কড় অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে প্রকাশ্যে রোগীর গলা কাটা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট। অনেক সময় ভুয়া এসব অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে ডাকাতি-ছিনতাই ও মাদক পরিবহনের মতো গুরুতর অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। গত ২১ আগস্ট ভোরে রাজশাহীর শাহ মখদুম থানার পোস্টাল একাডেমির সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে সাত ডাকাত নেমে অস্ত্র ঠেকিয়ে তিন পান ব্যবসায়ীর ৩৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে জানা যায়, নীল রঙের ওই অ্যাম্বুলেন্সটি (ঢাকা মেট্রো চ ১১-৩৫৫২) এক সময় ছিল মাইক্রোবাস। ভাড়ায় খাটার পাশাপাশি প্রায়ই এই বাহনে চড়ে ছিনতাই-ডাকাতি করা হতো।

এদিকে মাইক্রোবাস কেটে শুধু একটি বিছানা বসিয়েই বানানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স। চলে না এসি। অনেকটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পর্যন্ত নেই। আবার অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও তাতে থাকে না গ্যাস। তবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের অধীনে অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন শুধু বাংলা বর্ণমালার ‘ছ’ সিরিয়ালে দেওয়া হলেও ঢাকায় অসংখ্য অ্যাম্বুলেন্স দেখা গেছে ঢাকা মেট্রো-য় ও ঢাকা মেট্রো-চ সিরিয়ালের। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, প্রথমত ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সুজোগ নেই। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধন পেতে রোগীর জন্য স্থায়ী শয্যা (মাথার দিকে রিভলবিং), অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মাস্ক, চিকিৎসক বসার ব্যবস্থা, স্ট্রেচার ও সাইরেন থাকতে হবে। এ ছাড়া চিকিৎসাসেবায় প্রাথমিক জ্ঞানসহ চালক, চিকিৎসক, রোগীসহ সর্বোচ্চ ছয়জন বহন করা যাবে। ঢাকা মেট্রো-য় মূলত শোরুম নম্বর। পোর্ট থেকে শোরুম পর্যন্ত আনা ছাড়া এটা রাস্তায় চলারই অনুমতি নেই। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রো-চ মাইক্রোবাসের সিরিয়াল। জানা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সে নেই রুটপারমিটের বাধা। সাইরেন বাজালেই চলে যাওয়া যায় সড়কের যে কোনো পাশ দিয়ে। দিতে হয় না দেশের ৬৪টি সেতুর টোল। নীতিমালা বা ভাড়া নির্ধারিত না থাকায় ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা যায়। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অ্যাম্বুলেন্সকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট। অন্যদিকে রাজধানীর বড় বড় সরকারি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ২ থেকে ১০টির মধ্যে। এগুলোর মধ্যে আবার অনেকটি নষ্ট থাকে বছরব্যাপী। নেই চালক। যেগুলো সচল আছে, সিন্ডিকেটের কারণে সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পান না রোগীরা। জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকা ও একচেটিয়া ব্যবসার কারণে ব্যক্তিমালিকানায় অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকাতেই অ্যাম্বুলেন্স নিবন্ধন হয়েছে ৫ হাজার ৬০৩টি এবং সারা দেশে নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্স ৮ হাজার ৯৬টি। আর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির হিসাবে সারা দেশে অ্যাম্বুলেন্স চলছে ১০ হাজারের বেশি। ২ হাজারের মতো পুরোপুরি অবৈধ। ভাড়া নৈরাজ্য ও মাইক্রোবাস কেটে অবৈধ অ্যাম্বুলেন্সের কথা স্বীকার করে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে সবার আগে প্রয়োজন হয় আম্বুলেন্সের। ১৯৮৩ সালের মোটরযান বিধিতে নিবন্ধনের আওতায় দেশে ২০ ধরনের সড়ক পরিবহনের মধ্যে ১ নম্বরে অ্যাম্বুলেন্সের নাম থাকলেও জরুরি সেবামূলক এই বাহন ব্যবহারে কোনো নীতিমালা নেই। এ কারণেই ভাড়া নৈরাজ্য। অনেক সময় রোগী নিজে গাড়ি আনলেও তাতে উঠতে দেওয়া হয় না। সব মালিক এটা করে না। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে জানিয়েছি। এক্ষেত্রে ৯৯৯ এ কল করে জানাতে পারেন রোগীরা। এসব সংকট দূর করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটা নীতিমালা করার জন্য বলছি। অ্যাম্বুলেন্সকেন্দ্রিক সমস্যাগুলো তুলে ধরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ডকে লিখিত আকারে জানিয়েছি। তিনি বলেন, বিআরটিএর শর্তে বলা আছে অ্যাম্বুলেন্স ব্যক্তিমালিকানায় ও ভাড়ায় চালানো যাবে না। তাহলে এসব রোগীরা কীভাবে যাতায়াত করবে? হাসপাতালে তো অ্যাম্বুলেন্স নেই। অনেকে অন্য গাড়ি কেটে অবৈধভাবে অ্যাম্বুলেন্স বানাচ্ছে। বিআরটিএ নিবন্ধন দেওয়ার পর খোঁজ না রাখায় এই সুযোগ পাচ্ছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিআরটিএ মূলত হাসপাতালের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের অনুমোদন দেয়। এর বাইরে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ যদি হাসপাতালের নাম দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন নেয়, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। এদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। তিনি বলেন, কিছু অসাধু অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির নেতারা আমার কাছে অভিযোগ করেছেন। একই সঙ্গে অনুমোদনহীন অ্যাম্বুলেন্সের কথাও বলেছেন। আমরা বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখছি। তিনি বলেন, বিআরটিএ শুধু বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে। এর বাইরে আর কোনো পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে না। অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও মালামাল পরিবহনে গাড়ির ভাড়া সাধারণ মানুষের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা মালিকদের সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে নির্ধারণ করে। এখানে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই। আর সব ক্ষেত্রেই নীতিমালা করা যায় না।


আরো পড়ুন